Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

ভাষা ও সংষ্কৃতি

রায়েরকাঠী জমিদারদের চেষ্টায় শহর পিরোজপুরের পত্তন হয় । অবসরকালীন চিত্তবিনোদনের জন্য থিয়েটার, যাত্রা, কবিগান, জারীগান, পুতুল নাচ, ঘোড়ার দৌড়, ষাড়ের লড়াই, নৌকাবাইচ, মেলা বহুরূপীর খেলা ইত্যাদির আসর বসতো রায়েরকাঠীতে। এখানে শিবচতুর্দশীতে এমনই এক ঊৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি হত যা সারা দক্ষিণ বাংলার মানুষের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। রায়েরকাঠির মাঠে এই মেলা ৫/৬ দিন ধরে চলত। দূরদুরান্ত থেকে মানুষ এই মেলায় আসার জন্য বছর ধরে অপেক্ষায় থাকত। কত বছর পূর্বে এ মেলা শুরু হয় তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি।

কদমতলার জগদাত্রী পূজা উপলক্ষে যাত্রা, জারীগান, কবিগান, ষাড়ের লড়াই, লাঠি খেলা প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় । এখানে কৃষ্ণলীলা, রাস উৎসবকে কেন্দ্র করে যাত্রা থিয়েটার হয়।

পিরোজপুরের মাছিমপুরে ধোপা বাড়ির নিকটবর্তী মাঠে ধানকাটা মৌসুম শেষ হলেই ঘোড়ার দৌড় প্রচলন ছিল। এই খেলায় অংশ নেওয়ার জন্য বিত্তবান লোকেরা বিভিন্ন জাতের ঘোড়া সংগ্রহ করতেন। ১৯২১ সালে গোপালকৃষ্ণ টাউন হল নামে পাবলিক হলটি নির্মিত হয় । এই হলটিকে কেন্দ্র করে খেলাধুলার জন্য টাউন ক্লাব ও একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এটি শেরেবাংলা পাবলিক লাইব্রেরী নামে পরিচিত।

১৯২৫-২৭ সালের দিকে কতিপয় মুসলিম তরুণ বর্তমান ঈদগার পূর্ব পাশে মুসলিম ক্লাব নামে আর একটি ক্লাব গঠন করে। পরবর্তী সময়ে শেরেবাংলা ফজলুল হকের খালার নামে সামছুন্নেছা মুসলিম হল নামে একটি মিলনায়তন তৈরী হলে মুসলমান তরুণ যুবকেরা এখানে আর একটি পাঠাগার গড়ে তোলে। এখানে সাপ্তাহিক বিতর্ক, সভা কবিতা পাঠ, ইসলামী গান বিশেষ করে মিলাদুন্নবী ঊপলক্ষে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ কেন্দ্রেই কবি আহসান হাবিব প্রথম তার কবিতা পাঠ করেন। এই কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকাতায় শংকরপাশার মকবুল বয়াতীর নাম দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামী গান, নজরুল ইসলামের গান ছাড়া ও তিনি বৃটিশ বিরোধী বিভিন্ন গান হাটে হাটে গাইতেন। কলিকাতার হিজ মাস্টার ভয়েজ তাঁর এজিদের কারাগারে, জয়নালের কান্না গানটি রেকর্ড করে। গানটি গ্রাম বাংলার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৩৫ সালে রাজা ৮ম এডওয়ার্ডের সিংহাসন আরোহনের রজতজয়ন্তী পালন উপলক্ষে পিরোজপুর বাসীও উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে । পিরোজপুরের বলেশ্বর নদে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে প্রায় ২০ খানা নৌকার বাইচ অনুষ্ঠিত হত। চলিসা গ্রামের লেহাজ উদ্দীনের ছিপ নৌকা ঢোলের উম্মাতাল তালে দুলে দুলে সর্বাগ্রে গন্তব্যে পৌছে বৃহৎ এক পিতলের কলসী উপহার পায়। রায়েরকাঠী প্রদর্শনী ময়দানে তারিনী মিস্ত্রী ও চুঙ্গাপাশার রাশেদ মল্লিকের ষাড়ের মধ্যে চুড়ান্ত লড়াই শুরু হলে প্রচন্ড উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। দুইদল সমর্থকদের মধ্যে এসময় লড়াই বেঁধে যায়, অবশ্য জমিদার সত্যেন্দ্রনাথ রায়ের প্রচেষ্টায় হাঙ্গামার দ্রুত নিস্পত্তি ঘটে। বিভিন্ন উৎসবে বাজিকার উমাচারণ, গঙ্গাচরণ চমৎকার আতসবাজির কারুকাজ প্রদর্শন করেন। সঠিকভাবে জানা না গেলেও গঙ্গাচরণ মাছিমপুরে বসতি স্থাপন করে তার বিদ্যালয় লক্ষীকান্তসহ অনেককে পারদর্শী করে তোলেন এই বাজিকরেরা ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত পিরোজপুরের বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে রঙ-বেরঙের বাজি দেখিয়ে আনন্দ দিয়েছেন।

বাংলাদেশের খ্যাতিমান অভিনেতা গোলাম মুস্তফা ও তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মোহাম্মদ মুসার ছেলেবেলা কেটেছে পিরোজপুরে। তাঁর অভিনয়, আবৃত্তি ও সংগীত বেশ কিছুকাল পিরোজপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে । ঢাকায় ২/১ টি সিনেমা হল নির্মিত হলেও মফস্বলে তেমন ছবি দেখানোর ব্যবস্থা হয়নি । কৃষ্ণনগরের আবছার তালুকদার ও তাঁর বন্ধুরা মিলে কলিকাতা থেকে ভ্রাম্যমান সিনেমা নিয়ে আসেন। সারা শহরের পার্শ্ববর্তী হাটে বাজারে টিনের তৈরী চোঙ্গা দিয়ে চলমান এবং কথা বলা সিনেমা দেখানোর প্রচার করলে গোপালকৃষ্ণ টাউন হলে প্রচুর ভিড় জমে। ছবি দেখানো শুরু হওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই নারী দর্শকদের অত্যাধিক চাপে হলের দোতালা ভেঙ্গে পড়ে এবং অনেকে আহত হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে পিরোজপুর শহরে চিত্রবানী নামে একটি সিনেমা হল চালু হলেও অল্প দিনের মধ্যে তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের পর ইরাটকিস ও আলেয়া নামে দুটি সিনেমা হল চালু হয়। ১৯৬২-৬৩ সালে আলেয়া সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যায় । ১৯৯১ সালে ইরাটকীস সিনেমা হলটি ও বন্ধ হয়ে যায়।

এতদঞ্চলের মধ্যে সর্বপ্রথম মুসলমানদের মধ্যে যুক্ত অপেরা নামে একটি পূর্ণাঙ্গ যাত্রা দল গড়েন। কবি নজরুলের বিষের বাঁশি পালাটি যুক্ত অপেরার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় পালার স্বীকৃতি পায়।  নুরুল ইসলাম, নিরোধ বরণ সরকার, বিজয় বকশি, জিন্নাত আলী মোক্তার এদের প্রচেষ্টায় ওয়াই,সি,এ, নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তারা প্রায় নিয়মিতভাবে টাউন হল মঞ্চে বিভিন্ন নাটক অভিনয় করতেন। নুরুল ইসলাম, বিজয়ী বকশী, মোদাচ্ছের মিয়া, সুধীর বাবুরা মিলে ‘নিউ মিনার্ভা  অপেরা’ নামে আর একটি যাত্রাদল গড়ে তোলেন। যা এখন কোলকাতায় মিনার্ভা থিয়েটার নামে সমাধিক পরিচিত।

পিরোজপুরের প্রায় প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে তখন শিক্ষাবর্ষ শেষে ‘শিক্ষা সপ্তাহ’ উদযাপিত হত। নাট্যাভিনয়, কবিতা আবৃত্তি, সংগীত, কমিকস উপস্থাপনা করে আমন্ত্রিত অতিথিদের আনন্দ দিত। স্কুলে স্কুলে ফাতেহা ইয়াজদহম, মিলাদুন্নবী, স্বরসতীপূজা উপলক্ষে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত। বিশেষ করে পূজামন্ডবের ধোঁয়ায় আছন্ন ও ধূপের গন্ধ ছড়ানো আরতি নৃত্য প্রতিযোগিতা দেখার জন্য প্রচুর দর্শক সমাগত হত। পাড়ায়-মহল্লায় নিয়মিত নজরুল-রবীন্দ্র জন্ম-জয়ন্তী পালিত হত।

১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুথানের সময় প্রায় সব জনসভা শেষে গণসংগীত গেয়ে দীপক মজুমদার, আঃ হাকিম, শংকর মসিদ, রবীনদাস, আবুল কালাম মহিউদ্দিন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৬৪,৬৫,৬৬ সালে পিরোজপুর কলেজের সংস্কৃতিবান ছাত্র-ছাত্রীদের প্রচেষ্টায় ‘দায়ী কে’ ‘টাকা আনা পাই’ ও ‘ফেরিওয়ালা’ নাটক মঞ্চস্থ হয়। পিরোজপুর কলেজের বেশ কয়েকজন তরুণ ছাত্র ও অধ্যাপক মিলে ‘লিটলম্যান’ নামক ইংরেজি নাটক কলেজ মিলায়তনে সাফল্যের সাথে মঞ্চায়ণ করে। পিরোজপুরে অভিনীত এটিই একমাত্র ইংরেজি নাটক। ওই সময় আর্টস কাঊন্সিল, অফিসার ক্লাবের প্রায় নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ হত। তখনকার অফিসার্স ক্লাবের কর্মকর্তা পি, আর, দত্ত চেীধুরী, শহীদ ফয়জুর রহমান (সাহিত্যিক হুমায়ুন আহম্মেদের পিতা), সরকারি কাজের অবসরে নাটকের মহড়া দেখতে প্রায় প্রতিদিন লেডিস ক্লাবে উপস্থিত থাকতেন।

৭০ দশকের শেষে লুৎফুল কবীর, আবুল কালাম, আঃ হালিমরা মিলে ‘মঞ্চমালঞ্চ’ নামে একটি নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। লুৎফুল কবীর তার নাটক ‘শতাব্দীর আবিস্কার’ লিখে প্রশংসিত হন। ১৯৭২ সালে বাদল কুমার মিত্র ও তার বন্ধুরা মিলে প্রথমে ক্রান্তি ও পরে ঝংকার শিল্পীগোষ্ঠী নামে ২টি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং কিছুকাল পরে ২টি সংগঠনই বিলুপ্ত হয়ে যায়।

১৯৭৩ সালে মাহমুদ সেলিম, মুনিরুল করিম, সিরাজুল ইসলাম হিরণ প্রমুখ ‘যুব সাংস্কৃতিক দল’ গঠন করে তৎকালীন তথ্য মজলিস মিলায়তনে সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। ১৯৭৪ সাল সারাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। পিরোজপুরে ও লঙ্গরখানা খুলে ক্ষুধার্ত জনতার মুখে খাদ্য তুলে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চলেছে। আঃ হালিম খান, জামালুল হকসহ বেশ কিছু রাজনীতি সচেতন সাংস্কৃতিক কর্মী মুকাভিনয়ের মাধ্যমে টাউন হল ময়দানে একটি নাটক মঞ্চস্থ করে। সমাজের অসংগতিগুলো ব্যাঙ্গ ও বিদ্রুপের মাধ্যমে তুলে ধরাই এই নাটকের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। এই মূক নাটকের গৌরাঙ্গ লাল আইচ (জুয়েল আইচ) শুধুমাত্র মুখের সাহায্যে আবহসংগীতের ব্যঞ্জনা দিয়ে পরিবেশনা মানের সমৃদ্ধি ঘটান । নাটকটি পরে আরো পরিশীলিত করে টাউন হল মঞ্চে ৭২ এর স্ফুলিঙ্গ নামে অভিণীত হয়। হুলারহাট মঞ্চে নাটকটি মঞ্চায়ন করতে গেলে রক্ষীবাহিনীর হস্তক্ষেপে নাটকটি অভিনয় করতে ব্যর্থ হয়ে অভিনেতা ও নাট্যকর্মীরা নাটকের সাজপোষাকেই পিরোজপুরে হেঁটে আসেন। পথিমধ্যে রক্ষীবাহিনী নাটকের অভিনেতা সামছুদ্দোহা মিলনকে স্থানীয় এম,পি, ভেবে স্যালুট দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

১৯৭৬ সালে উদীচী ও দিশারী শিল্পীগোষ্ঠি রবীন্দ্রনাথের‘ রক্তকরবী’ নাটক মঞ্চস্থ করে। প্রয়াত যাদুকর জে, এন, সাহা মঠবাড়িয়ার মোঃ মোশারফ হোসেন একুশে প্রভাত ফেরী গানের রচয়িতা ও বিশ্বখ্যাত যাদুকর জুয়েল আইচ ছাড়াও অভিনয়শিল্পী হিসাবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন রাজ, আবুয়াল হোসেন প্রমুখ। সংগীতা শিল্পীগোষ্ঠী পিরোজপুর উদীচী, দিশারী শিল্পীগোষ্ঠী, রূপান্তর নাট্যগোষ্ঠী, নাট্যচক্র, পিরোজপুর থিয়েটার, কৃষ্ণচুড়া থিয়েটার, বলাকা নাট্য নীড়সহ কয়েকটি নাট্যসংগঠন নিয়মিত নাট্যচর্চা করছে। অভিনেতা গোলাম মুস্তফা পিরোজপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পিরোজপুরে প্রখ্যাত শিল্পী খালিদ হাসান মিলুর ছেলে প্রতীক হাসান, মাহতাব উদ্দিন টুলু, শিপ্রা রানী কর্মকার, পঙ্কজ কর্মকার ও মিহির রায় সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পিরোজপুরের অরুন কর্মকার নৃত্যশিল্পী হিসাবে ভূমিকা রেখেছেন। পিরোজপুরের জায়েদ খান চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। আবৃত্তি, নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা হিসাবে আ,ফ,ম, রেজাউল করিম, নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা খান দেলোয়ার, সালেহউদ্দিন সেলিম ও আতিকুর রহমান হিরু বেশ পরিচিত নাম।

পিরোজপুর অফিসার্স ক্লাব,  গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাব, বলাকা ক্লাবসহ প্রভৃতি অংগসংগঠন ভাষা ও সংস্কৃতির অগ্রযাত্রায় বিশেষ ভুমিকা রাখছে। এছাড়া যেসব সরকারী সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা পিরোজপুরে কাজ করছে সেগুলো হলোঃ

    - জেলা শিল্পকলা একাডেমী, পিরোজপুর।
    - সরকারী গণগ্রন্থাগার, পিরোজপুর।