দেশের অন্যান্য স্থানের মত তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমার প্রতিটি গ্রামে গড়ে ওঠে প্রতিরোধের দূর্গ। ৭ মার্চ হতে ২৫ মার্চ পর্যন্ত মিছিল, মিটিং প্রতিদিন কমবেশি হত। গ্রামাঞ্চলের মানুষদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য ছাত্র ইউনিয়ন ন্যাপ, আওয়ামী লীগের নেতরা বেশ সক্রিয় ছিলেন।
২৫ মার্চ ৭১ রাত ১২টা ২০ মিনিটে প্রথম পিরোজপুরে ঢাকার সংবাদ পৌছে। তখন ছাত্রলী নেতা পিরোজপুরের আঃ মালেক খান আবু পিরোজপুর শহরে মাইকে প্রচার করেন- প্রিয় দেশবাসী পাকিস্তানি হায়নারা ঢাকায় আক্রমন করেছে। আপনারা যে যেখানে আছেন সবাই যার যা আছে তাই নিয়ে থানায় উপস্থিত হউন’ এ সময় যার যা কিছু ছিল লাঠিসোটা বল্লম নিয়ে হাজার হাজার মানুষ পিরোজপুর শহরে বেরিয়ে পড়ে।
২ মার্চ ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) শহরে বাশের লাঠি ও ডামি রাইফেল নিয়ে সদর রাস্তায় মহরা প্রদর্শন করলে পথচারী জনসাধারণ করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানায়। ৩ মার্চ বিকেলে ঢাকা থেকে আগত শামছুল হক (এম,এন,এ মঠবাড়ীয়া) ছাত্রলীগ নেতা ওমর ফারুক ও আওয়ামী লীগ নেতা বদিউল আলমের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের কর্মীরা পিরোজপুরে পাকিস্তানি পতাকায় অগ্নিসংযোগ করতে করতে মিছিল করে শহর প্রদক্ষিণ করে। ছাত্রলীগ নেতা ওমর ফারুক ২৩ মার্চ শতশত জনতার উপস্থিতিতে টাউন হল মাঠের শহীদ মিনারে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়িয়ে দেন। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতেই বরিশাল থেকে নূরুল ইসলাম মঞ্জুর টেলিফোনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠান এসময় পিরোজপুরের আওয়াগী লীগের এম,এন এ ছিলেন অ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খান। ২৫ মার্চ গভীর রাতে ছাত্রলীগ নেতা আঃ মালেক খান আবু পরদিন ২৬ মার্চ শহরবাসীকে বিকেলে টাউন হল ময়দানের জনসভায় উপস্থিত থাকতে মাইকে আহবান জানালেন সর্বদলীয় ঐ জনসভায় অ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খানের অস্ত্র সংগ্রহের আবেগময় ও নির্দেশমূলক আহবান ছিল বলে জনতা টাউন হলের অদূরে অবস্থিত ট্রেজারি আক্রমন করে সমস্ত রাইফেল, বুলেট সংগ্রহ করে নেয়। অস্ত্র সংগ্রহের সময় বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ফজলুল হক খোকন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
অস্ত্রগার লুণ্ঠনঃ
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। সংগ্রাম পরিষদের জনসভা চলছিল গোপাল কৃষ্ণ টাউন ক্লাব মাঠে। এই সভায় তদানীন্তর এম, এন,এ অ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খান ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংস, নির্মম হত্যাকান্ডের বিবরন দিয়ে ভাষন দেয়ার সময় স্বাধীনতাকামী উপস্থিত জনতা উত্তেজিত হয়ে ‘ অস্ত্র চাই অস্ত্র চাই’ ধ্বনি দিতে থাকলে তিনি জনতাকে আশ্বস্ত করে বলেন আজ এখনই অস্ত্রাগার লুন্ঠন করে তোমাদের হাতে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য অস্ত্র তুলে দেয়া হবে। বক্তব্য শেষ হওয়ার সাথে সাথে উত্তেজিত জনতা অস্ত্রাগারের দিকে এগিয়ে যায়। পিরোজপুরের মহকুমা প্রশাসকের অফিস সংলগ্ন অস্ত্রাগারটি লুণ্ঠনে নেতৃত্ব দেন অ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খান, ডাঃ আব্দুল হাই, ডাঃ ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডল, অ্যাডেভোকেট আলী হায়দার খান, ফজলুল হক খোকন প্রমুখ। সুশৃংখলভাবে এখান থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। তারমধ্যে ৪২ টি রাইফেল হস্তগত করে নকশালপন্থীরা, ২২ টি বন্দুক চলে যায় শান্তি কমিটির হাতে। ২৮ মার্চ পিরোজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এখানে সাধারণ মানুষদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
পিরোজপুর পাক-হানাদার বাহিনী প্রবেশের পর ১৯ মে ১৭৯১ অস্ত্রাগারের আরএসআই গোলাম মাওলা বাদী হয়ে পিরোজপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পিরোজপুর থানার এই ৫নং মামলাটিতে ৫৫ জনকে আসামী করা হয়। ঐতিহাসিক এই অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মামলার আসামীরা হলেন- ১) এনায়েত হোসেন খান, ২) ডাঃ আব্দুল হাই, ৩০) ডাঃ ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডল, ৪) আলী হায়দার খান, ৫) ফজলুল হক খোকন, ৬) জামানুল হক মনু, ৭)শহীদুল হক চান, ৮) ফারুক হোসেন, ৯) সেলিম, ১০) পূর্ণেদু বাচ্চু, ১১) প্রবীর, ১২) দুলাল, ১৩) ওবায়দুল করীম, ১৪) ইয়াকুব আলী সিকদার, ১৫) শহীদুল ইসলাম মন্টু, ১৬) বলরাম দাস, ১৭) আব্দুল বাতেন, ১৮) আঃ লতিফ, ১৯) আবুল কালাম মহিউদ্দিন, ২০) সালাউদ্দিন টুকু, ২১) মনির হোসেন, ২২) তপন চক্রবর্ত্তী, ২৩) ওবায়দুল হক, ২৪) সমীর দাস, ২৫) বাবুল, ২৬) স্বপন, ২৭) আব্দুস সালাম, ২৮) রনজিৎ, ২৯) দিলীপ মন্ডল, ৩০) নিখিল, ৩১) সজল, ৩২) হীরালাল, ৩৩) সামসুদ্দোহা, ৩৪) লুৎফর কবীর, ৩৫) রুস্ত্তম আলী, ৩৬) বাদশা, ৩৭) মুনান, ৩৮) আব্দুল মালেক, ৩৯) সাইদুর রহমান, ৪০) কেষ্ট, ৪১) ওমর ফারুক, ৪২) খোকন, ৪৩) নুরুল আমীন, ৪৪) খালেদ রবি, ৪৫) আঃ মান্নান, ৪৬) রফিকুল, ৪৭) মোজাম সিকদার, ৪৮) দোলোয়ার হোসেন, ৪৯) সিদ্দিকুর রহমান, ৫০) নুরুজ্জামান গাজী, ৫১) কামালউদ্দিন, ৫২) হামদু সিকদার, ৫৩) আব্দুস সালাম, ৫৪) আবু ফকির, ৫৫) হেমায়েত উদ্দিন।
২৭ মার্চ পিরোজপুরের সদ্য গঠিত মুক্তিফৌজ, অস্থায়ীভাবে গঠিত বিপ্লবী সরকারের স্থানীয় প্রধান অ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খান এম,এন,এ কে গার্ড অব অনার প্রদান করে। ঐ সময় এনায়েত হোসেন খান, ডাঃ আব্দুল হাই, আলী হায়দার খান, ডাঃ ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডল এই চারজন হাই পাওয়ার পলিটিক্যাল নেতা পিরোজপুর মহাকুমার মুক্তি সংগ্রামে দিক নির্দেশনামূলক গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখেন। এ সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন মেমন গ্রুপের ফজলুল হক খোকন, ওবায়দুর কবীর বাদল, নূরদীদা খালেদ রবি, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এম এ মান্নান, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শহীদুল্লাহ খান (মতিয়া) ছাত্রলীগ নেতা ওমর ফারুক (পরবর্তীতে শহীদ), আ,স,ম সিদ্দিক, এম এ মুহিত সরদার, আজিজুর রহমান সিকদার, শফিজউদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজুল হক কাঞ্চন, হেমায়েত উদ্দিন আহম্মেদ, এ কে এম এ আউয়াল, এম ডি লিয়াকত আলী শেখ বাদশা, হেমায়েত হোসেন বাদশা, এ কে এম সেলিম (নাজির), বেলায়েত হোসেন সেলিম, হুমায়ুন কবির খোকন সহ অসংখ্য মানুষ মুক্তিফৌজ গঠন ও গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন।
হুলারহাট বন্দরে প্রথম পাক-বাহিনীর গানবোট ভিড়ে ৩ মে ১৯৭১। ১৭ এপ্রিল নগর সরকার গঠন হওয়ার পর পিরোজপুর মহাকুমা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকারের সাথে সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে। এসময় পিরোজপুর স্কুল মাঠ ও কালেক্টরেট মাঠে মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষণ নেয়। পুরোদমে চালু হয়ে গেলো স্বাধীন বাংলাদেশের সীল, তখন পিরোজপুর ট্রেজারি অফিসার সাইফ মিজানুর রহমান ট্রেজারীর অস্ত্র ও সমস্ত টাকা পয়সা তুলে দেন মুক্তি বাহিনীর হাতে। পিরোজপুরে তখন এসডিও ছিলেন ফয়জুর রহমান। তিনি তার পুলিশ বাহিনী নিয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন পিরোজপুরের মুত্তিযোদ্ধাদের।
৫ মে ৭১ বলেশ্বর খেয়াঘাটে দাড় করিয়ে এক সঙ্গে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে তাদের লাশ ফেলে দেওয়া হয় বলেশ্বর নদীতে। বলেশ্বর নদীর পাড়ে পুরানো খেয়াঘাট ও তার আশেপাশের ঘাট ছিল হত্যাযজ্ঞের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। পিরোজপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বলেশ্বর খেয়াঘাটের গুরুত্ব অত্যাধিক। ৫ মে ৭১ বলেশ্বর খেয়াঘাটে গুলি করে হত্যা করা হয় তারমধ্যে যেসব শহীদদের নাম পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে শহীদ আঃ রাজ্জাক, শহীদ সাইফ মিজানুর রহমান ও শহীদ ফয়জর রহমান আহমেদও ছিলেন। বলেশ্বর খেয়াঘাট বধ্যভূমিতে এরাই প্রথম হত্যাকান্ডের শিকার হন।
২১ মার্চ লে, জিয়াউদ্দিন পিরোজপুর এসে ইপিআর, আনসার, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক ছাত্র-যুবকদের সমন্বয় পিরোজপুর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষণ দিতে থাকে। বামপন্থী নেতৃত্বে করিমুন্নেছা গালর্স হাইস্কুল ও ওয়াবদা চত্ত্বরে গেরিলা ট্রেনিং সেন্টার গড়ে ওঠে। এ সময় কদমতলা জর্জ হাইস্কুল মাঠেও মুক্তিফৌজের ট্রেনিং শুরু হয়।
পিরোজপুর শহরতলীতে রায়েরকাঠী জমিদারবাড়ির পরিত্যক্ত ভবনে গড়ে ওঠে একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত সৈনিক সফিজ উদ্দিন আহমেদ এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ওয়ারলেস সেট, দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র ও বেশ কিছু অত্যাধুনিক অস্ত্রসস্ত্র ছিল এ ক্যাম্পে। এ ক্যাম্পে হাবিবুর রহমান সিকদার, গৌতম নারায়ন চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা , আঃ আজিজ মোল্লা, এমদাদুল হকসহ মোট ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নেন।
১৬ জুন হত্যা করা হয় বিধান চন্দ্র হালদার মন্টুকে। তৎতকালীন বিপ্লবী ছাত্রনেতা সেলিম, পূর্ণেন্দু, বাচ্চু, প্রবীর দেবু, পংকজ, আসাদ, দুলাল, অনিল, প্রতুল, অনীন্দ্র কর্মকার, মতিলাল সাহা, কৃষ্ণচন্দ্র, রাম, নির্মল, বিমল, মহেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পাক সেনাদের হাতে শহীদ হন। কাউখালীর সুভাষ চন্দ্র দত্তকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে পাকবাহিনী। পিরোজপুর সদর থানার তেজকাঠী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে খালের তীরে এক সাথে ২৩ জনকে হত্যা করা হয়।
পিরোজপুরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন পর্যায়ে পাক বাহিনীর হাতে পৈশাচিক নৃশংসতায় শহীদ হয়েছেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা, তাদের মধ্যে ২৮ জন মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য ১৯৭৮ সালে তৎতকালীন মহকুমা প্রশাসক ডঃ সালাহ উদ্দীনের উদ্যোগে বলেশ্বর নদীর পূর্বপাড়ে নির্মিত হয় একটি স্মৃতিসৌধ। এটি পরিচিতি লাভ করে পুরাতন খেয়াঘাট বধ্যভূমি হিসেবে।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS